মোছাঃ শাপলা খাতুন : রুয়ান্ডার গণহত্যা ছিল নব্বই দশকের নৃশংসতম গণহত্যা। এ গণহত্যায় মাত্র একশ দিনে হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ৮ লক্ষ মানুষকে। এ গণহত্যার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এটি সংগঠিত হয়েছিল রুয়ান্ডার দুই বিবাদমান সম্প্রদায়ের মধ্যে। এ সম্প্রদায় দুটি ছিল হতু ও তুতসি । হতুরাই মূলত তুতসিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল।
এতো সল্প সময়ে এতো মানুষকে কেনই বা হত্যা করা হলো ? বা এ গণহত্যার পেছনের প্রেক্ষাপটই বা কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হয় ৭৮ বছর আগে অর্থাৎ ১৯১৬ সালে। মূলত এই সালের ঘটনা প্রবাহের মধ্যেই এ গণহত্যার পরোক্ষ কারণসমূহ বিদ্যমান। ১৯১৬ সালে বেলজিয়াম সেনাবাহিনী রুয়ান্ডা দখল করে নেয়। রুয়ান্ডার এই দুটি বিবাদমান জাতির মধ্যে বিবাদের নতূন মোড় শুরু এখান থেকেই। হতু ও তুতসিরা আলাদা সম্প্রদায়ের হলেও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ একই ছিল তবে শারিরীক দিক থেকে তুতসিরা হতুদের চেয়ে লম্বা আর চিকন ছিল। সবকিছু এক হওয়া সত্বেও বেলজিয়ামরা তুতসিদের সবকিছুতে অগ্রাধিকার দিতো কারণ তারা তুতসিদের হতুদের চেয়ে বেশি যোগ্য মনে করতো। সুযোগ সুবিধাও বেশি ভোগ করতো তুতসিরা। অথচ হতু সমপ্রদায় ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হতু আর তুতসিদের মনোমালিন্য বাড়তে থাকে। তাদের এ দ্বন্দ্বে আগুনে ঘি ঢালার মতো আরো কিছু কাজ করেছিল বেলজিয়ামরা। তারা দুই সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা আলাদা পরিচয়পত্র তৈরি করে দেয় যদিও তাদের দেশ ও জাতি ছিল অভিন্ন। এর মাধম্যেই দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিরাজমান দ্বন্দ্ব পাকাপোক্ত হয়।
তাদের মধ্যেকার রেষানল যে চরমে পৌঁছেছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৯ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। এ দাঙ্গায় প্রাণ যায় প্রায় ২০ হাজার মানুষের। দাঙ্গাকালীন সময়ে অনেক তুতসিই তাদের প্রাণ রক্ষা করার জন্য প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডি,তানজানিয়া এবং উগান্ডায় পালিয়ে যায়।
এর তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৬২ সালে বেলজিয়ান সরকারকে পদচ্যূত করে হতুরা ক্ষমতায় আসে। এরপর থেকে তুতসিদের আধিপত্য কমতে থাকে। ১৯৭৩ সালে রুয়ান্ডার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জুভেনাল হাবিয়ারিনামা। তিনি ছিলেন হতু সম্প্রদায়ের। তার শাসনামলের শেষের দিকে তার বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ দেখা দেয়। এর কারণ ছিল অর্থনৈতিক অচলাবস্থা।
সেই সময় ১৯৯০ সালে রুয়ান্ডার বর্তমান প্রেসিডেন্ট কাগামের নেতৃত্বে গড়ে উঠে “রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়াটিক ফ্রন্ট”। এ সশস্ত্র দলটির সদস্য ছিল পালিয়ে যাওয়া তুতসিরা আর কিছু মডারেট হতুরা। এই দলের উদ্দেশ্যে ছিল দুটি –
ক. হাবিয়ারিনামাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা।
খ. পালিয়ে যাওয়া তুতসিদের আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিনামাও তার ক্ষমতা সুদৃঢ় করতে হতু নেতাদের একত্রিত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে সরকার বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীদের মধ্যে কয়েকদফা আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে। এরপর তাদের মধ্যে একটা শান্তি চুক্তি হয়। যদিও এ শান্তি চুক্তি দ্বন্দ্বের অবসান করতে পারেনি।
১৯৯৪ সালের ৬ই এপ্রিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিনামাকে বহনকারী বিমানে মিসাইল হামলা হয়। সে সময় সেই বিমানে বুরুন্ডির প্রেসিডেন্টসহ কয়েকজন সেনাকমকর্তাও ছিল । এ হামলায় প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা নিহত হন। ফলে এর দায়ভার স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দলের উপর বর্তায়। যদিও এটার কোন প্রমাণ ছিল না।
৭ এপ্রিল ১৯৯৪, এ দিনটি ছিল তুতসিদের জন্য ভয়াবহ দিন কারণ এ দিনেই হতুরা তুতসিদের উপর নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল । এ গণহত্যা কার্যক্রম পরিচালনা করে হাবিয়ারানামা সমর্থিত বাহিনী, হতু রাজনৈতিক নেতৃবিন্দ, হতু ব্যবসায়ীসহ সরকারী সেনাবাহিনী মিলে ৩০,০০০ সদদ্যের এক সম্মিলিত বাহিনী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ‘ হতু পাওয়ার রেডিও‘ এর মাধ্যমে সব তুতসিদের হত্যা করে রুয়ান্ডার বুক থেকে তুতসিদের একেবারে নিচিহ্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা গণহত্যার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে চাপাতি ও গুলি। অধিকাংশ তুতসিকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তারা নারী ,শিশুদেরকেও এ হত্যাকান্ড থেকে রেহায় দেয়নি। এ হত্যাযজ্ঞ চলছিল ৭ এপ্রিল হতে জুলায়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এ যুদ্ধে হতুদের সাহায্যে করেছির ফ্রান্স ও আফ্রিকার কিছু দেশ ।যদিও ফ্রান্স তাদেরকে সাহায্যের কথা স্বীকার করে না। আর অসহায় তুতসিদের সাহায্যে করেছিল উগান্ডা। এই গণহত্যায় নিহত হয় প্রায় ৮ লক্ষ তুতসি । শুধু তাই নয় সেই সাথে ধর্ষিত হয়েছিল আড়াই থেকে পাঁচ লাখ তুতসি নারী ।
জাতিসংঘ এ যুদ্ধ থামাতে ফান্সের শান্তিরক্ষী বাহিনীকে সেখানে প্রেরণ করেছিল । এই শান্তি মিশনটি পরিচালনা করেছিলেন Romeo Dallaire । কিন্তু তারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন। এই গণহত্যা সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে বিশ্ব দরবারে তা আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু জাতিসংঘ এটিকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিতে চাননি। যার জন্য জাতিসংঘকে অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হতু ও তুতসি সম্প্রদায় মিলিত ভাবেই সরকার গঠন করে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন বিজমুংগু। তিনি ছিলেন হতু সম্প্রদায়ের এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নিবার্চিত হন কাগামে। তিনি ছিলেন তুতসিদের নেতা। যিনি বর্তমান রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হিসাবে কর্মরত।
লেখক: এমফিল গবেষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাবি।